স্কুল শিক্ষার ভবিষ্যৎ

এই পোস্টটা পড়লে আপনি অস্থির হয়ে উঠবেন , দিশেহারা হয়ে যাবেন….কিন্তু এখন সেটাই দরকার। তবে উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে যদি বিপদ এড়াতে চান তাহলে এক্ষুনি পড়া বন্ধ করুন….
প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি , আমারও একটা চার বছরের বাচ্চা আছে নাম “ডোডো” …আপনার মত আমিও আমার বাচ্চার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত …. তাই চারটি উল্টোপাল্টা কথা বলে আপনাকে ভয় পাওয়ানো আমার লক্ষ্য না ।
আপনারা যদি ভেবে থাকেন আমি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দুর্নীতি নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে বসেছি তাহলে ভুল করবেন … আমি আরো গভীরে , আরো ফান্ডামেন্টাল জিনিস নিয়ে আপনাদের সাবধান করতে চাইছি।
একদম প্রথমেই একটা খুব আতঙ্ক ধরানোর মতো প্রশ্ন দিয়ে শুরু করি …. “পড়াশোনা করে কী হবে?”
যাঁরা এই পোস্টটা পড়ছেন তাদের ১০০ জনের মধ্যে নব্বই জনের মনের মধ্যে যেটা গেঁথে আছে সেটা এরকম ” পড়াশোনা করবে , ভালো রেজাল্ট করবে ….তারপর ডাক্তার হবে… ইঞ্জিনিয়ার হবে বা চাকরী করবে “
ভুল করছেন….আপনারা আজ থেকে কুড়ি বা তিরিশ বছর পরের পৃথিবীটাকে Foresee করতে পারছেন না। আজ থেকে কুড়ি বা তিরিশ বছর পরেই কিন্তু আপনার বাচ্চাটা রোজগার করতে বাড়ির বাইরে বেরোবে।
অনেকে বলে AI নাকি সব চাকরি খেয়ে নেবে ….ভুল বলে। AI অলরেডি অনেকের চাকরি খেয়ে নিয়েছে! তাই “খেয়ে নেবে” জিনিসটা ভুল…. “খেয়ে নিয়েছে” বলাটা ঠিক!
আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও পোস্টার মেকিং , অ্যাড মেকিং , ফটো এডিটিং , ভিডিও এডিটিং এর ওপর কাজ করে কতো মানুষকে সংসার চালাতে দেখেছি…আজ তারা কোথায়? ফটো ভিডিও মেকিং AI অ্যাপ গুলো এদের জীবিকা ছিনিয়ে নিয়েছে ।
প্রসঙ্গত বলে রাখি আমি নিজে সফটওয়ার ইঞ্জিনীয়ার , প্রায় চোদ্দ বছর এই ইন্ডাস্ট্রীতে আছি। AI , ডেটা সাইন্স, এলগরিদম এসব নিয়ে ভালই আইডিয়া আছে।
আজকের পৃথিবীটা খুব তাড়াতাড়ি বদলাচ্ছে , আপনি যতোটা চিন্তা করতে পারবেন না পারছেন তার থেকেও দ্রুত বদলাচ্ছে… দু তিন বছরের মধ্যে টেকনোলজি ল্যান্ডস্কেপ পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে । নিজেই ভাবুন ChatGPT কদিন এসেছে পৃথিবীতে?
আজকের দিনেই AI বট গুলো খুব এফিসিয়েন্টলি আপনার যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। অনেকে বলবেন ChatGPT অনেক সময় ভুলভাল উত্তর দেয় … কথাটা কিন্ত সম্পুর্ণ সত্যি না । আপনি ChatGPT কে অথেনটিক ডেটা সোর্স যেমন পৃথিবীর বড় বড় এডুকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোর ওয়েবসাইট দিয়ে ট্রেনিং করিয়ে Custom Gpt বানিয়ে নিতে পারলে একদম নির্ভুল উত্তর পাবেন ।
আর এটা কিন্তু খুব সহজেই করা যায় । আপনি একটু বুদ্ধিমান হলে , জিনিসগুলো জানলে এটা করতে এক সপ্তাহের বেশি লাগা উচিত না ।
তো আপনি কী করলেন …. আপনার বাচ্চা CBSC বোর্ডে ক্লাস সেভেনে পড়ে …আপনি আপনার বাচ্চার বইটাকে স্ক্যান করে , ইমেজ টু টেক্সট কনভার্টার দিয়ে টেক্সট জেনারেট করে সেই ডেটা দিয়ে বানিয়ে দিলেন একটা Custom Gpt আপনার বাচ্চাকে ….সাথে সেটাকে ইন্টারনেট এর বিভিন্ন অথেনটিক ব্লগ গুলোর সাথে লিঙ্ক করিয়ে দিলেন …
গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যেকোনো প্রাইভেট টিউটর এর থেকে এই Custom Gpt অনেক বেশি নির্ভুল হবে , অনেক বেশি এফিশিয়েন্ট হবে ।
মনে রাখবেন এই সবটাই করতে পারবেন একদম বিনামূল্যে! ওপেন সোর্স প্লাটফর্ম দিয়ে।
এখন প্রশ্নটা হচ্ছে আপনি যদি বিনা পয়সায় আপনার বাচ্চার জন্য AI প্রাইভেট টিউটর বানাতে পারেন তো মাসে মাসে টাকা দিয়ে একজন প্রাইভেট টিউটর রাখবেন কেনো?
আজকের দিনেই এই অবস্থা , ভাবুন আজ থেকে কুড়ি বছর বাদের পৃথিবীটার কথা । ওই পৃথিবীতে কোনো মানুষ “প্রাইভেট টিউটর” থাকবে না , শুধু “AI টিউটর” থাকবে।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও জ্ঞানের কদর ছিলো , যে অনেক জানতো লোকে সন্মান দিয়ে বলতো “লোকটা প্রচুর জানে !”
…আজকের দিনে জ্ঞানের কোনো কদর নেই । সত্যি নেই। হাতের কাছে মোবাইল …মোবাইলে ইন্টারনেট …ইন্টারনেটের সাথে AI….. যখন ইচ্ছা যেটা ইচ্ছা এক মুহূর্তে জেনে নিতে পারবেন !
আজ থেকে কুড়ি বছর বাদের পৃথিবীতে কোনো “মানুষ ডাক্তার” থাকবে না , কারণ দরকার পড়বে না। ডাক্তারের প্রয়োজন পড়ে আপনি অসুস্থ হলে কী অসুখ সেটা ডায়াগনোসিস করার জন্য বা অপরেশন করার জন্য ।
জানিয়ে রাখি আজকের দিনে এমন মেশিন আছে যার মধ্যে আপনাকে ঢুকিয়ে দিলে মেশিন নিজে থেকেই আপনার ব্লাড প্রেসার , ব্লাড সুগার , হার্ট বিট , ইসিজি….এমআরআই সব কিছু অটোমেটিক্যালি করে আপনাকে জানিয়ে দেবে আপনার ঠিক কী হয়েছে ।
মেডিক্যাল টেকনোলজি খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে । শুনতে খারাপ লাগলেও জেনে রাখুন আজ থেকে কুড়ি বছর বাদের পৃথিবীটা মানুষ ডাক্তারদের জন্যও খুব একটা সহজ হবে না। ডাক্তারদের অনেক কাজ মেসিন নিয়ে নেবে।
এরকম আরো হাজার একটা উদাহরণ দিয়ে আপনাদের শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল হাওয়া বইয়ে দিতে পারি …কিন্তু সেটা উদ্দেশ্য না । সমস্যা সমস্যা করে হাজার চিল্লালেও কারো কোনো উপকার হবে না যদি না পথ দেখানো যায়।
তাহলে পথটা কী?
এবার যেগুলো বলবো মন দিয়ে শুনুন –
প্রথাগত স্কুল শিক্ষার কোনো ভবিষ্যৎ নেই..সে বাংলা বোর্ড হোক বা CBSC। তাই আপনার বাচ্চা স্কুলে র্যাংক করছে কিনা সেটা নিয়ে অযথা মাতামাতি করে নিজের সময় আর আপনার বাচ্চার ছোটোবেলাটা ধ্বংস করবেন না । মোটামুটি ভালোভাবে পাস করে গেলেই খুশি থাকুন ।
উল্টো বুঝবেন না ….. আপনার বাচ্চার স্কুলে যাওয়াটা জরুরি …আর পাঁচটা বাচ্চার সাথে মেশাটা জরুরি … এমনকি এক্সাম গুলোকেও সিরিয়াসলি নেওয়াটা জরুরি ….. সে যতই অর্থহীন হোক না কেনো । জ্ঞান অর্জন ছাড়াও এই স্কুল জিনিসটা মানুষকে অনেক কিছু শেখায়।
হাজারটা প্রাইভেট টিউশন দিয়ে আপনার বাচ্চাটার সারাদিনটা ব্লক করে দেবেন না । এটা করছেন মানে আপনি একটা অর্থহীন জিনিসের পিছনে আপনার সময় , অর্থ সব খরচ করছেন ।
আপনার বাচ্চাটাকে খেলতে দিন … ছুটতে দিন। আপনার বাচ্চা যতো ফ্রী টাইম পাবে নিজে থেকে ভাবতে শিখবে। ক্রিটিকাল থিংকিং মানুষের মজ্জাগত ….সেই কারণেই আজ মানুষ নামক জীবটা সারা পৃথিবীতে রাজ করছে । মানুষের না আছে গোরিলার মতো শক্তি , বা বাঘের মতো চোয়াল বা কুমিরের মতো দাঁত ….কিন্তু তাও পৃথিবীটা মানুষের দখলে কারণ মানুষ ন্যাচারালি ক্রিটিকাল থিংকিং করতে পারে ।
আপনার বাচ্চাটাও তাই । একটু ফ্রি টাইম দিন …দেখবেন প্রথমে বোর হবে ….তারপর কিছু একটা নিয়ে ক্রিটিকাল থিংকিং করবে । এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
একটা বাচ্চা সকাল এগারোটা থেকে তিনটে পর্যন্ত স্কুল করার পর সারাদিনে যদি তাকে আরো দু তিনটে প্রাইভেট টিউশন দিয়ে দেন তাহলে সে মানসিক ভাবে ক্লান্ত থাকবে…. ক্লান্ত মনে ক্রিটিকাল থিংকিং হয় না ।
অনেকে আবার ভালো স্কুল , ভালো স্কুল করে বাড়ি থেকে বহুদূরে বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করে । স্কুল বাসে করে যেতে এক ঘণ্টা আসতে এক ঘণ্টা ….যেতে আসতেই বাচ্চা মানসিক ভাবে ক্লান্ত … কী করে করবে ক্রিটিকাল থিংকিং ??
তাই হয় নিজের বাড়িটাকেই তুলে সেই ভালো স্কুলের কাছে নিয়ে যান , বা বাড়ির কাছে মোটামুটি স্কুল পেলে সেখানেই বাচ্চাকে ভর্তি করুন। দিনে দু ঘণ্টা বাসে ট্রাভেল মানে কিন্তু ওই ছোটো বাচ্চাটার কাছে অনেকটা!
আপনি বলবেন কী তখন থেকে ক্রিটিকাল থিংকিং ক্রিটিকাল থিংকিং করে যাচ্ছেন ….বাচ্চা ভালো করে পড়বে , স্কুলে র্যাঙ্ক করবে …. কিন্তু তারপর?
কিন্তু তারপর কী করবে?
ভাবুন , তারপর কী করবে?
তারপর আপনার বাচ্চাটা এমন এক দুনিয়ায় জীবিকা খুজতে বেরোবে যেখানে এই প্রথাগত স্কুল শিক্ষা , যেখানে শুধু মানুষকে তথ্য অর্জন করতে উৎসাহ দেওয়া হয় …সেই শিক্ষার দাম কেউ দেবে না কারণ আজ ইন্টারনেট এর দৌলতে সব তথ্য হাতের মুঠোয়।
তাহলে সেই দুনিয়ায় কীসের মূল্য থাকবে ?
ক্রিটিকাল থিংকিং এর মূল্য থাকবে , এমনকি আজকের দিনের থেকেও সেই দিনে এই জিনিসের মূল্য বাড়বে! কারণ আজকের স্মার্টফোন অ্যাডিকশন এর দৌলতে বাচ্চাদের মধ্যে ক্রিটিকাল থিংকিং একদম তলানিতে ।
খুব খুব ভুল রাস্তায় যাচ্ছে আমাদের পরের প্রজন্ম। যে দুনিয়া আসছে তার জন্য এরা প্রস্তুত না ।
আর আজকার বাবা মা রাও সেরকম … অর্থহীন জিনিসের পিছনে ছুটে চলেছে …. এবাকাস্ করে কী উপকারটা হবে আপনারাই চিন্তা করুন।
এবাকাস্ একটা মেকানিকাল পদ্ধতি…যেটার সাহায্যে বড়ো বড়ো যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করা যায় ….বুঝলাম ….কিন্তু এটা বাচ্চাটার লাইফে কোন কাজে লাগবে আমাকে একটু জানান । বড়ো বড়ো ক্যালকুলেশন করার জন্য ক্যালকুলেটর তো আছে !
এবাকাস্ নিয়ে যাঁরা বিসনেস করছেন তারা ঝাঁপিয়ে পড়বেন। বলবেন এতে বাচ্চার মানসিক বিকাশ হয়। ঘণ্টা হয়….যে জিনিসটাই পুরোপুরি মেকানিকাল, যার মধ্যে কোনো লজিক নেই , শুধু কতোগুলো মেকানিকাল স্টেপস আছে সেটা কোনো বাচ্চার মানসিক বিকাশ করতে পারে না।
এই এবাকাস্ , এই হ্যাট ওই হ্যাট…. সব আপনার বাচ্চাকে নিয়ে আপনার ইনসিকিউরিটি কে এক্সপ্লইট করে একদল পাঁড় ব্যবসায়ী ব্যবসা করে যাচ্ছে। এর বেশি কিছু না।
পাশের ফ্ল্যাটের রেহান এর মা ওকে সপ্তাহে তিনদিন এবাকাস্ করতে নিয়ে যায় আর আমার বাচ্চাটা করে না ! চল তোকেও নিয়ে যাই….. অসুস্থ কম্পিটিশন….বাবা মা দের মধ্যে।
তারপর প্রাইভেট টিউশন । আজকের দিনে আপনার বাচ্চাকে অন্তত তিন চারজন আলাদা আলাদা টিউটর না দিলে সোসাইটিতে ঠিক জাতে ওঠা যায় না….এটা না করলে পাড়া প্রতিবেশীর কথা শুনবেন …সবাই চিন্তিত হয়ে পড়বে আপনার বাচ্চা আদৌ মানুষ হবে তো?
আজকাল কোনো বাচ্চা নিজে পড়ে দেখে না বইয়ে কী লেখা আছে। ওদেরকে সবকিছু গিলিয়ে দেওয়া হয়। গিলে খেতে খেতে এরা চিবাতে ভুলে যাচ্ছে।
এদের হাতে একটা নতুন বই দিয়ে বলুন নিজে থেকে পাঁচটা পাতা পড়ে আপনাকে বোঝাতে যে কী বুঝলো ….. করে দেখুন । বিপদটা বুঝে যাবেন।
পাঁচটা টিউটর দিয়ে বাচ্চাকে স্পুন ফিডিং করিয়ে ক্লাসে এক থেকে তিনের মধ্যে হওয়ার থেকে আপনার বাচ্চা যদি নিজে পড়ে কুড়ি নাম্বারে আসে সেটা অনেক গুণে ভালো …অন্তত একটা ভালো অভ্যাস তৈরি হবে।
আজকাল বাচ্চাদের শখ বলে কিছু নেই। একটা বাচ্চা হয়তো আঁকতে ভালোবাসে …বাবা মা সেটা আবিষ্কার করা মাত্রই জুড়ে দিলো আঁকার স্কুলে …তারপর বাড়িতে আঁকার টিউশন … আঁকার কম্পিটিশন….. এদিকে এতো কিছুর চাপে বাচ্চাটার আঁকার ইচ্ছাটাই চলে গেলো!
বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তবে প্রত্যেকের ভাবাটা দরকার। যেদিন বুঝবেন বাচ্চাদের ফ্রী টাইম মানে ওয়েস্টেড টাইম না সেদিন দেখবেন আপনি কিছুই করছেন না অথচ আপনার বাচ্চা পরের পর পরীক্ষায় দুর্দান্ত রেজাল্ট করে যাচ্ছে ।
আসলে গাছের মতোই … আপনার কাজ খালি সঠিক পরিবেশটা দেওয়া .….তারপর নিজের মতো ছেড়ে দিলে গাছের মতোই বাচ্চারাও ভালো থাকে।
(সংগ্রহীত)
See less